উচ্চ রক্তচাপ- এক নীরব ঘাতক
18 May 2016 Latest
হাইপারটেনশন, যার অপর নাম উচ্চ রক্তচাপ। HTN বা HPN হলো একটি রোগ, যখন কোন ব্যাক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে। হাইপারটেনশনকে প্রাথমিক (আবশ্যিক) হাইপারটেনশন অথবা গৌণ ভাগ করা হয়। প্রায় ৯০–৯৫% ভাগ ক্ষেত্রেই “প্রাথমিক হাইপারটেনশন” বলে চিহ্নিত করা হয়। উচ্চ রক্ত চাপের কোন উল্লেখ যোগ্য কারণ কোন চিকিৎসা-শাস্ত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
“নিজের রক্তচাপকে জানুন” এটি ছিল এ বছর উচ্চ রক্তচাপ দিবসের প্রতিপাদ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বে মারা যায় উচ্চ রক্তচাপের জটিলতার কারণে। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এবং স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর ৫১ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপই মৃত্যুর কারণ।
শ্রেণীবিভাগঃ সাধারণভাবে বলা হয়, যদি কোনও একজনের রক্ত চাপ উভয় বাহুতে ১২০/৮০ বা তার উপরে থাকে, তাহলে তার উচ্চ রক্ত চাপ আছে বলে বলা যেতে পারে। সাধারণত, ১৩৯/৮৯ রক্ত চাপ টর থেকে ১২০/৮০ টরকে সংজ্ঞায়িত করা হয় “প্রিহাইপারটেনশন”। (টর-চাপের একটি একক) প্রিহাইপারটেনশন একটি রোগ নয়, কিন্তু এ থেকে কোন ব্যক্তির উচ্চরক্তচাপ বিকশিত হওয়ার একটি যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ডায়াবেটিস মেলিটাস অথবা কিডনী রোগীদের ক্ষেত্রে গবেষনায় দেখা গেছে, ১৩০/৮০ অধিক রক্তচাপে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং এর তাড়াতাড়ি চিকিৎসা হওয়া উচিত।
শ্রেণীবিভাগ |
হৃদ-সংকোচন চাপ | হৃদ-প্রসারণ চাপ | ||
mmHg | kPa | mmHg | kPa | |
সাধারণ | ৯০–১১৯ | ১২–১৫.৯ | ৬০–৭৯ | ৮.০–১০.৫ |
প্রিহাইপারটেনশন | ১২০–১৩৯ | ১৬.০–১৮.৫ | ৮০–৮৯ | ১০.৭–১১.৯ |
পর্যায় ১ | ১৪০–১৫৯ | ১৮.৭–২১.২ | ৯০–৯৯ | ১২.০–১৩.২ |
পর্যায় ২ | ≥১৬০ | ≥২১.৩ | ≥১০০ | ≥১৩.৩ |
বিচ্ছিন্ন হৃদ-সংকোচন হাইপারটেনশন |
≥১৪০ | ≥১৮.৭ | ||
উৎস: আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (২০০৩) |
দুই অবস্থায় রক্তচাপ পরিমাপঃ
সংকোচনশীল (সিস্টোলিক-Systolic) অবস্থায়:
হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হৃৎপিণ্ড হতে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। এ সংকোচনের সময় চাপের পরিমাপ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সাধারণত ১২০ মিলিমিটার মার্কারি (mmHg), তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপের মাত্রা বাড়তে থাকে।
প্রসারণশীল (ডায়াস্টলিক-Diastolic) অবস্থায়: এ অবস্থায় কার্বনডাইঅক্সাইড যুক্ত রক্ত শরীর থেকে হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে। এসময় এর চাপ প্রাপ্ত বয়স্কদের সাধারণত ৮০ মিলিমিটার মার্কারি (mmHg), এর মাত্রাও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের কারণঃ সাধারণ দুই ধরনের রক্তচাপে ভুগেন মানুষ। এগুলো হচ্ছে- প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ ও সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ।
প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ: সাধারণত উচ্চরক্ত চাপের ৯০ ভাগ কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়না। তাই যে রক্তচাপের কোনো কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়না তা হচ্ছে প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ। এ ধরনের উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের জন্য খুব বিপজ্জনক এবং নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। কারণ এ ধরনের রক্তচাপ প্রতিরোধ না হলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জটিল হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ: চর্বি বা রক্ত জমাট বেধে রক্তনালী সরু হলে আড্রেনাল গ্রন্থেফোরা বা টিউমার হলে, কিডনির সমস্যা হলে, কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে যেমন ব্যাথানাশক ওষুধ (ইবুপ্রফেন, নাপ্রক্সেন) সেবন করলে বাকি ১০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এটি নিরাময় যোগ্য, চিকিৎসা নিলে সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যেসব কারণ রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের পেছনেঃ
• অতিরিক্ত ওজন
• পরিবারের কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
• অতিরিক্ত মাত্রায় লবণ খেলে
• পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি না খেলে
• নিয়মিত হাঁটা-চলা বা ব্যায়াম না করলে
• অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (যেমন- চা, কপি) পান করলে
• অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালকোহল পান করলে
• বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে
উচ্চরক্তচাপ সর্বাপেক্ষা সাধারণ জটিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অসুস্থতার একটি। এখন পর্যন্ত ৫০ টির অধিক জিনকে চিহ্নিত করা হয়েছে উচ্চ রক্তচাপের গবেষণার জন্য এবং এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বৃক্কের উচ্চরক্তচাপ বৃক্কজনিত অসুস্থতার কারণে ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে যা হয় তা হল , বৃক্কের কলাসমূহের মাঝে রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেয়, কারণ রেনেন-এনজিওটেন্সেন সিস্টেমের প্রধান অথবা শাখা ধমনী সমূহ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে।
যদিও উচ্চ রক্তচাপ আলাদাভাবে কোন অসুস্থতা নয়, কিন্তু প্রায়ই এর চিকিৎসা প্রয়োজন হয়; কারণ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর এর স্বল্প থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে। বিশেষত স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিউর, হৃদক্রিয়া বন্ধ, চোখের ক্ষতিএবং বৃক্কের বিকলতা ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
যদিও খুব বেশি গর্ভবতী নারী গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ অনুভব করেন না, কিন্তু শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত নারী গর্ভধারণের কারণে উচ্চ রক্তচাপের স্বীকার হন।
চিকিৎসাঃ মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকেরা ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়ামকে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে ধরেন। যদিও এই পদ্ধতিগুলি রক্তচাপ কমানোর জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসু, কিন্তু এইগুলি বলার চেয়ে করা প্রকৃতপক্ষে সহজ ন্য। বেশীরভাগ রুগীই মাঝারী থেকে উচ্চ রক্তচাপে যারা ভূগছেন, তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঔষধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাদের রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য। যদিও ধূমপান ছেড়ে দেয়া সরাসরি রক্তচাপ কমায় না, কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সাথে এটি অত্যন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের বেশকিছু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আসে যেমন স্ট্রোক অথবা হার্ট এটাক। মৃদু উচ্চরক্তচাপ সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং শারিরীক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। ফল, শাক সব্জি, স্নেহ বিহীনদুগ্ধজাত খাদ্য এবং নিম্নমাত্রার লবণ ও তেলের খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট রোগীর রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম রক্ত চলাচলের উন্নতি করে, এবং রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দের পরিবেশ বা অতিরিক্ত আলো পরিহার করাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী হতে পারে। রক্তচাপ ৫-৬ টর কমালে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ৪০%, করোনারী হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ১৫-২০% কমিয়ে আনে এবং হার্ট ফেইলিউরের সম্ভাবনাও কমে আসে। চিকিৎসার মূল লক্ষ হওয়া উচিত, ১৪০/৯০ টরের নিচে রক্তচাপকে নিয়ে আসাআর কিছু ক্ষেত্রে আরো নিচে নিয়ে আসা যেমন ডায়বেটিস বা কিডনীর রুগীদের ক্ষেত্রে। প্রতিটি ঔষধ আলাদাভাবে সিস্টোলিক চাপ ৫-১০ টর কমিয়ে নিতে পারে। তাই কারো কারো ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক ঔষধের প্রয়োজন হয়।
প্রতিকারঃ ওপরের উল্লেখিত কোনো লক্ষণ আপনার দেখা দিলে সর্বপ্রথম আপনার জীবন ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য আপনাকে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে-
• ওজন বেশি হলে ওজন কমাতে হবে
• নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটতে হবে
• পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে
• ধূমপান পরিহার করতে হবে
• অ্যালকোহলের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে
• খাবারে লবণের মাত্রা কমাতে হবে এবং চা, কফির অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
সচেতনতা ও পরামর্শ: বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরিমাপ করুন। উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত চিকিৎসা নিন। কোলস্টোরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। পরামর্শমতে জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে চিকিৎসার মাধ্যমে এ নীরব ঘাতকের ছোবল থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখুন।
সচেতনতার মধ্যে সঠিক ডায়েটের গুরুত্ব অনেক বেশি। সঠিক ডায়েট শুধু রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণেই রাখে না, বরং রক্তচাপের মাধ্যমে তৈরি সমস্যাগুলো প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে।
ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক ওজন বজায় রাখার লক্ষ্যে উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে খাদ্যের ক্যালরি যথাযথভাবে মেনে চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাদ্য অবশ্যই কম গ্রহণ করতে হবে। চিনি, অতিরিক্ত ভাত, আলু, মিষ্টি—এই জাতীয় শর্করাযুক্ত খাবার কম খেতে হবে।
চর্বিজাতীয় খাবার অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে, যেমন: গরুর মাংস, খাসির মাংস, কলিজা, মগজ, বড় চিংড়ির মাথা, ডিমের কুসুম, বেকারির খাবার, বাটার, ঘি, ভাজা জাতীয় খাবার ইত্যাদি। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ ফ্যাটজাতীয় খাবার ব্লাডপ্রেশার কমাতে সাহায্য করে, যেমন: জলপাইয়ের তেল, ফুলকপি, বাদাম, মাছ ইত্যাদি। সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লবণ হলো সোডিয়ামের খুব ভালো উৎস। প্রতিদিন রান্নায় চার থেকে পাঁচ গ্রাম (১ চা চামচ = ৫ গ্রাম) পর্যন্ত লবণ ব্যবহার করা ভালো। খাবারের সময় আলাদা লবণ পরিহার করতে হয়। লবণাক্ত খাবার, যেমন : চিপস, পাপড়, চানাচুর, আচার ইত্যাদি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
পটাশিয়ামযুক্ত খাবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক জরুরী। পটাশিয়াম রক্তের সোডিয়ামের মাত্রা যথাযথভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করে। ডাবের পানি, কলা, টমেটো, গাঢ় সবুজ শসা, সবজি, সালাদ পটাশিয়ামের ভালো উৎস, যা উচ্চ রক্তচাপ রোগীর খাদ্যতালিকায় থাকলে তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
প্রোটিনজাতীয় খাদ্য উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে একটু হিসাব করে খেতে হয়। মুরগির মাংস, মাছ, ডিমের সাদা অংশ, লো ফ্যাট দুধ, টক দই, ডাল ইত্যাদি প্রোটিনের ভালো উৎস।
এ রোগ নিয়ন্ত্রণে লবণের সঙ্গে পান-জর্দা-তামাক পরিহার করা উচিত।
এ রোগ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। সঠিক নিয়ম মেনে সময়মতো পরিমিত খাবার খেলে এবং জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তন করে সহজেই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
Comments
comments
Webmaster Blood Presure, Health