On Air
Peoples Morning Gossip in Morning
Home
  • Home
  • জয়নুল আবেদীন

জয়নুল আবেদীন

28 May 2016 Latest


আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসাধারণ কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন। ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের তিনিই পুরোধা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউ) তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণে অন্যান্য শিল্পীদের সংগঠিত করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি এমন এক স্থানে এটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে বাস্তবিক পক্ষে অতি নিকট অতীতেও শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাভিত্তিক কোনো ঐতিহ্য ছিল না। জয়নুল আবেদিন ও তার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর অক্লান্ত চেষ্টায় মাত্র এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা তার স্থান করে নেয়। জয়নুল আবেদিনের অসাধারণ শিল্প- মানসিকতা ও কল্পনাশক্তির জন্য তিনি শিল্পাচার্য্য উপাধিতে ভূষিত হন।

জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। তিনি বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্রের লালিত্যে গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামলিমায়। জয়নুল তাঁর প্রথম জীবনেই নদী ও অবারিত প্রকৃতির মাঝে রোমান্টিকতার অনুপ্রেরণা পান।

পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরও কত কি এঁকে মা- বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু মাত্র কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখার বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। তার মা ছেলের এই আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার তখন আর্ট স্কুলে ভর্তি করান এবং পাঁচ বছর সেখানে ব্রিটিশ কারিকুলামে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ছেলে জয়নুল আবেদিনও মায়ের সেই ভালবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের “ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং” ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি আর্ট স্কুল অনুষদে যোগ দেন এবং তিনি তাঁর চিত্রাঙ্কন চালিয়ে যেতে থাকেন। একই বছরে সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তাঁর অঙ্কিত জলরঙের ছবির জন্য তিনি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। তাঁর অঙ্কনের মূল বিষয়বস্ত্ত ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল তাঁর আশৈশব প্রেরণার বিষয়। এ স্বীকৃতিই তাঁকে প্রথমবারের মতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। তিনি নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টির আত্মবিশ্বাস লাভ করেন।

জয়নুল আবেদিনের কাছে প্রাচ্যের অঙ্কন ধারা অতিমাত্রায় রীতি নির্ভর ও অপরিবর্তনশীল মনে হয়েছে, যা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। অন্য দিকে ইউরোপীয় ধারা তার কাছে সীমাবদ্ধ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে তিনি রিয়েলিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। রেখা চিত্রের ওপর তার দুর্বলতা থেকেই যায় এবং দৈনন্দিন জীবনচিত্রের উপস্থাপনায় তিনি এর ব্যবহারে আনেন বহু বৈচিত্র্য। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে জয়নুল আবেদিন ধারাবাহিকভাবে একাধিক চিত্র স্কেচ করেন। এ দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সস্তা প্যাকিং পেপারে চাইনিজ ইঙ্ক ও তুলির আচরে ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’ নামে পরিচিত জয়নুলের এ চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে শব-সওদাগরদের নিষ্ঠুরতা ও নৈতিক কলুষতা, সে সাথে নিপীড়িতের অমানবিক দুর্দশা। চিত্রকর্মগুলি জয়নুলকে ভারতব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এগুলি মানুষের দুর্দশা, কষ্ট ও প্রতিবাদকে সামনে এনে বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কনে তার স্বকীয়তাকে বিকশিত করে। ‘দ্য রেবেল ক্রো’ (জলরং, ১৯৫১) এ ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন। উচ্চ মার্গীয় নন্দনতত্ত্বের মিশেলে সামাজিক অনুসন্ধিৎসা ও প্রতিবাদের সম্মিলিত প্রকাশ রিয়ালিজমের এ নির্দিষ্ট ধারা বিভিন্ন সময়ে জয়নুলকে প্রেরণা জুগিয়েছে: ১৯৬৯ ও ১৯৭১ এ সময় জয়নুল তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ করেছেন এ স্টাইলে।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর জয়নুল আবেদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। সে সময়ে ঢাকাতে কোনো আর্ট ইনস্টিটিউট বা অন্য কোনো শিল্প সম্বন্ধীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না। জয়নুল আবেদিন ও তার কয়েকজন সহযোগী, যারা দেশ ভাগের পর ঢাকায় অভিবাসী হয়েছিলেন, আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্ট-এ দুবছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। লন্ডন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর জয়নুলের চিত্রে নতুন একটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়, যাকে বলা যায় ‘বাঙালি ধারা’। এ ধারায় প্রাথমিক রঙের ব্যবহার ও পারসপেক্টিভের অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ বিষয়বস্ত্তকে তাদের জ্যামিতিক আকারে, অনেক সময়ে আধা- বিমূর্ত আদলের উপস্থিতি লক্ষণীয় করে তোলে। ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) ও ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩) হলো এ আমলের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম।

সমগ্র পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ধরে জয়নুল আবেদীনের কর্মে রিয়েলিজম, নান্দনিকতা, পল্লীর বিষয়বস্ত্ত ও প্রাথমিক রঙের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তবে কর্মপরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি লোক শিল্পকলার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন। এখানে ডাইমেনশনের অভাব, আলো আঁধারির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অনুপস্থিতি এবং তাদের গতিময়তার অভাব লক্ষণীয়। এ সীমাকে অতিক্রম করতে জয়নুল আবার ফিরে যান প্রকৃতির কাছে গ্রামীণ জীবনে, জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের মাঝে, সে সাথে রীতি বৈচিত্র্যের সমন্বয় ঘটিয়ে, যেখানে বাস্তবতা থাকবে মুখ্য কিন্তু অবয়ব হবে আধুনিক। জয়নুলের কাছে ‘আধুনিকতাবাদ’ বলতে শুধুই বিমূর্ততা ছিল না, বরং তাঁর কাছে ‘আধুনিকতা’ শব্দটির ছিল এক সুগভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য- যেখানে সামাজিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিক প্রকাশই মুখ্য।

তাই প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরী প্রতিবন্ধকতার বিরূদ্ধে সংগ্রামরত নর-নারীর বলিষ্ঠ শারীরিক গড়ন স্মরণ করিয়ে দেয় ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতার মাঝে আধুনিকতাবাদের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে। জয়নুলের কর্ম কেন্দ্রায়িত হয়েছে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নর-নারীর শ্রম ও সংগ্রাম এবং সে সাথে তাদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের মাঝে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে ভিত্তি করে আঁকা ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিং (চাইনিজ ইঙ্ক, জলরঙ ও মোম) ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারানো হাজারো মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আঁকা ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা’ পেইন্টিংটির মাঝে তাঁর কর্মের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। জয়নুল যদিও প্রকৃতি ও মানব জীবনের চিত্র (পল্লী রমণীর ব্যক্তিগত মুহূর্তও অন্তর্ভুক্ত) এঁকেছেন, তবুও ষাটের দশকের শেষ দিক ও সত্তর দশকে আঁকা তার ছবির মাঝে গতি পরিস্ফুটিত। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হলঃ ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৬৯-এ নবান্ন, ১৯৭০-এ মনপুরা-৭০, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃ‌তি।

বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তিনি হলেন জয়নুল আবেদীন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়। জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ বাড়িতে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু হয়। জয়নুল আবেদীন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট শাহবাগে স্থানান্তর করার পর ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে। তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এই সরকারি কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁও এ একটি লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে একটি গ্যালারি (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা) প্রতিষ্ঠা করেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর অংকিত কিছু চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুনরুজীবিত করার আন্দোলনে তিনি নিজেকে সংক্রিয়ভাবে জড়িত করেন। তিনি আশংকা করেছিলেন যে, কিছু পাশ্চাত্য টেকনিক ও রীতির প্রভাব যেগুলো এখানকার কিছু চিত্রশিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিল, দেশীয় রীতিকে ধ্বংস করবে। কিন্তু ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে তিনি তাঁর কাজ সম্পন্ন করতে পারেন নি। তার স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে, বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন সম্মানে “আবেদীন” নামে নামকরণ করা হয়।

কিংবদন্তী এই শিল্পী হাজারো বছর আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার অসামান্য সব সৃষ্টির মাধ্যমে। পিপলস রেডিও পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Comments

comments


Webmaster

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *