আসামের চা বাগানের চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী সংস্কৃতিবান, গান পাগল মানুষ। বাগানের কুলি, মজুরদের নিয়ে নাটক করতেন। শ্রমিকদের ওপর বৃটিশদের শোষন-বঞ্চনার প্রতিবাদ করতেন। একবার এক বাগান-ম্যানেজার তাঁকে গালি দিলে, চড় মারেন জ্ঞানেন্দ্র। সামনের পাটির তিনটি দাঁত পড়ে যায় লোকটির।
জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসুরী সলিল চৌধুরী। বাবার সংগৃহিত ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত আর আসামের লোকগান শুনে শৈশব কেটেছে। চা বাগানের শ্রমিকদের নিত্যদিনের বঞ্চনা ছোট্ট সলিলের ভিতরে প্রতিবাদের বীজ বুনে দেয়। সেই বীজ পত্র-পুষ্পে অঙ্কুরিত হয়েছিলো গানে গানে। ১৯৪৫ এ কৃষক আন্দোলনে সলিল লিখলেন, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে’, ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’, ‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’ ইত্যাদি গান। তেভাগা আন্দোলনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে নাটক লিখেছেন, পরে সেই সব চিত্রনাট্য চলচ্চিত্রের রূপ পায়। ‘দো বিঘা জমিন’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ এইভাবেই সিনেমা হয়ে ওঠে।
সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার সুরকার সলিল চৌধুরী শুধু বাংলা ভাষাতেই থেমে থাকেননি। হিন্দি সহ মোট চৌদ্দটি ভাষার ১৩৫টি ছায়াছবির স্বার্থক সঙ্গীত পরিচালক তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর কলম গর্জে ওঠে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য তিনি লিখলেন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা’-রক্তে জোয়ার জাগানিয়া গান।
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিরোধের আগুন’, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী এখানে থেমোনা’, ‘হেই সামালো ধান হো কাস্তেটা দাও শাণ হো জান কবুল আর মান কবুল আর দেবনা আর দেবনা রক্তে বোনা ধান মোদের প্রান হো’, ‘সেদিন আর কতদুরে, যখন প্রাণের সৌরভে সবার গৌরবে ভরে রবে এ দেশ’, ‘নাও গান ভরে, নাও প্রাণ ভরে চলো যাই যেখানে প্রান্তর সোনার ধানের শীষে ডাকে যেখানে সোনা ভরা অন্তর’, এরকম আরো অনেক অনেক গান সলিল চৌধুরীর লেখনীতে প্রান পেয়েছে। স্বল্প পরিসরে তার সবটা তুলে ধরা সম্ভব নয়।
পাশ্চাত্য আর ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের যুথবন্ধনে সলিল চেীধুরীর গান যুগোত্তীর্ন, কালজয়ী। সলিল চেীধুরী নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। লতা মঙ্গেশকারের কন্ঠে, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘যারে যারে উড়ে যা রে পাখি’, ‘ওগো আর কিছু তো নয়’, ‘না যেও না রজনী এখনো বাকী’, ‘আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমে চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়’, শ্যামল মিত্রের কন্ঠে, ‘যাক যা গেছে তা যাক’, ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’, ‘আহা ঐ আঁকা বাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে, ‘কোন এক গাঁয়ের বধুর কথা শোনাই শোনো’, ‘আয়রে ও আয়রে ভাইরে ও ভাইরে’ প্রভৃতি গান সলিল চেীধুরীর কথায় ও সুরে এক বিমূর্ত মূর্চ্ছনা।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পাল্কির গান’ আর সুকান্ত ভট্টাচার্য়্যের ‘অবাক পৃথিবী’, ‘রানার’, ‘ঠিকানা আমার চেয়েছ’ প্রভৃতি কবিতায় সুরারোপ করে সলিল চৌধুরী বাংলা গানকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দরাজ কন্ঠে গানগুলো আজো মানুষ তন্ময় হয়ে শোনে।
১৯২২ সালের ১৯শে নভেম্বর বিভাবতী দেবী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ঘর আলো করে সলিল চৌধুরী এসেছিলেন এ পৃথিবীতে। প্রতিভা আর সাধনায় জগত আলো করে অনন্ত নক্ষত্রলোকে তিনি পাড়ি জমান ১৯৯৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। কোনা স্বীকৃতি কিংবা পুরস্কারের নিক্তিতে সলিল চেীধুরীকে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ভারতীয় চলচ্চিত্র তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ। বাংলা গান যতদিন ভক্তের হৃদয়ে থাকবে সলিল চৌধুরী ও থাকবেন ধ্রুবতারা হয়ে।
আজ ১৯শে নভেম্বর, এই কালোত্তীর্ণ সঙ্গীত স্রষ্টার আগমনী দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তাঁর গানের কথা ধার করে। হে আলোর পথযাত্রী, এখানে থেমো না… অপারলোকে সুরের সুধা আছে কিনা জানা নেই, তবে তোমার সুরের মুগ্ধ শ্রোতা, তোমার বানীতে মুগ্ধ হৃদয় তোমাকে খুঁজে ফেরে তোমারই গানের আলোকলতায়।
Comments
comments