মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ। এই প্রকৃতির সাথে মানুষের এক গভীর সম্পর্ক আছে। কেউ হয়তো তা প্রকাশ করে আবার কেউ হয়তো প্রকাশ করে না। ঠিক তেমনি লালন শাহ্র রচিত বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়। তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ একজন মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়েছেন। লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৭৭৪ এবং মৃত্যু ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ সালে। লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী। তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না। তাই তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটা গানের মধ্য দিয়ে বরাবর প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি হয়তো একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করেছেন বলেই এমন একজন অসাধারণ মানুষ হতে পেরেছেন। তাঁর গানের মধ্যে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়, তাঁর জন্য তাকে বাউল সম্রাট উপাধিও দেয়া হয়। লালনের জীবনীর কথা যদি বলা হয় তাহলে দেখা জায় তেমন কোন কিছুই জানা যায়নি তাঁর জীবনীর সম্পর্কে। এমনকি তাঁর রচিত গানের মধ্যেও তিনি তাঁর জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য তিনি রেখে যান নি, তবে কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে “লালন ফকির” হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এতটুকু জানা গেছে, লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথিরা তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর পথ চলা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতেও দেখা যায় নি। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়। লালনের সকল ধর্মের লোকের সাথেই সুসম্পর্ক ছিল।
লালনের গানের পাশাপাশি তাঁর জীবনীর নির্ভরযোগ্য তথ্য ও লালন-দর্শনের মূল কথা নিয়ে অনেক নাটক, ছিনামা, ছোট নাটক রচিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়।আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষ-পরমতত্ত্ব, আল্লাহ্-নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ-গৌরতত্ত্ব এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে লালনের গান রয়েছে।
লালনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গানঃ
- আমি অপার হয়ে বসে আছি
- সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
- জাত গেলো জাত গেলো বলে
- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
- আপন ঘরের খবর লে না
- আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী
- মন তুই করলি একি ইতরপনা
- এই মানুষে সেই মানুষ আছে
- যেখানে সাঁইর বারামখানা
- বাড়ির কাছে আরশিনগর
- আমার আপন খবর আপনার হয় না
- দেখ না মন, ঝকমারি এই দুনিয়াদারী
- ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফান্দ পেতে
- সব সৃষ্টি করলো যে জন
- সময় গেলে সাধন হবে না
- আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
- তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
- এসব দেখি কানার হাট বাজার
- মিলন হবে কত দিনে
- কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা
তিনি ছিলেন অন্য রকম এবং অন্য চিন্তার ধারার একজন মানুষ। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেন : “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি করা হয়। আজও সারা বাংলাদেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। পিপলস রেডিওর পক্ষ থেকে এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে