নির্ভরতার পরম আশ্রয় – বাবা
20 June 2016 Latest
ভাষা ভেদে শব্দ বদলায়; স্থান ভেদে বদলায় উচ্চারণও। তবে বদলায় না কখনো আত্মার টান। “বাবা” – ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ এর বিস্তৃতি কত্ত বিশাল!! ডাকটির মাঝেই লুকিয়ে থাকে গভীর ভালবাসা, নিরাপত্তা ও নির্ভরতা। সন্তানের দুঃসময়ে বাবা ঘুচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সব কষ্ট। বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক পরম মমতা এবং বন্ধুত্বের।
ভাষা যেটিই হোক না কেন, কোনো শিশু যখন এই শব্দ উচ্চারণ করতে শেখে, তখন বাবার মন আনন্দে নিঃসন্দেহে এক স্বর্গীয় আনন্দে উদ্বেলিত হয় । সন্তানের কাছে বাবা বন্ধুর মতো। কারও কারও বাবা তার আদর্শ পথপ্রদর্শক।
সন্তানের কাছে চিরন্তন আস্থার প্রতীক তার বাবা। বাবা মানে একটু শাসন আর অনেক ভালোবাসা। বাবা মানে মাথার উপর বট বৃক্ষের শীতল ছায়া। বাবা মানে সকল চাওয়ার একটাও মিস না যাওয়া। বাবা মানে কাছের দুঃসময়ের সঙ্গী। বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ, আর একরাশ নিরাপত্তা। বাবারা এমনি হয়। রাগ, শাসন আর রাশভারী চেহারার পেছনে এই মানুষটির যে কোমল হৃদয়, তা মায়ের ভালবাসার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। কিছু কিছু ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের রূপটিই হয়তো কঠোর ।
বাবার প্রতি সন্তানের সেই চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও পৃথিবীর মানুষ বছরের একটা দিনকে বাবার জন্য রেখে দিতে চায়। যেমনটা আমরা আমাদের মায়ের জন্য করে থাকই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাবা দিবসের প্রচলন।
জুনের তৃতীয় রবিবার- “বিশ্ব বাবা দিবস” । বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে থেকে বাবা দিবস পালন শুরু হয়। মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল- এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে এর শুরু। ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ই জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জেনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয়। আবার, সনোরা স্মার্ট ডড নামক ওয়াশিংটনের একজন নারীও বাবা দিবসের কথা ভাবতে থাকেন। ডড এই আইডিয়াটা পান গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে, সেই পুরোহিত তার মা’কে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলছিলেন। তখন তার মনে হলও, তাহলে বাবাদের নিয়েও তো কিছু করা দরকার। ড তার বাবাকে খুব ভালবাসতেন। এরপর তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১০ সালের থেকে বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন। তাই সনোরা স্মার্ট ডড-কে কৃতিত্ব দেয়া হয়। তার বাবা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ ফেরত সৈনিক- যিনি একাই তার ছয় সন্তানকে বড় করে তোলার কজটি করেন। সনোরা স্মার্ট ডড মা দিবসের কথা শুনে মনে মনে স্থির করেন তার বাবার মত অন্য বাবার অবদানকেও স্বীকৃতি দেবার জন্য একটি দিন প্রয়োজন। তার বাবার জন্মদিন ছিল ৫ জুন। তিনি সে দিনটিকেই বাবা দিবস হিসেবে উদযাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গীর্জা কর্তৃপক্ষের হাতে প্রস্তুতির সময় না থাকায় জুনের তৃতীয় রবিবার প্রথমবাবের মত বাবা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। দিনটি ছিল ১৯শে জুন, ১৯১০। শুরুতে এটি বিশেষ সফলতা পায়নি। ১৯২০ সালে তিনি পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, বাবা দিবস উদযাপনও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। এরপর ১৯৩০ সালে নিজ শহর স্পোকারে ফিরে সনোরা আবার বাবা দিবস উদযাপন ও এর প্রসারে প্রচারণা শুরু করেন। এসময় তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের সহায়তা পান। ধূমপানের পাইপ, টাইসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর নির্মাতারা সুযোগটি লুফে নেয়। এর মধ্যে বাবা দিবস নিয়ে তীব্র সমালোচনাও শুরু হয়। একে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের একটি ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করা হয়। সংবাদপত্রে সমালোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্রুপাত্নক কৌতুক প্রকাশিত হয়। তবে ব্যবসায়ীরা হাল ছাড়েনি। ১৯১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বাবা দিবসকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার উদ্যোগ নিলেও বাণিজ্যিকীকরণের আশংকায় কংগ্রেস বাদ সাধে। এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাবা দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়াও ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রভাবে ধীরে ধীরে সব দেশেই বাবা দিবস পালন শুরু হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবারেই বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বের ৫২ টিরও বেশি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়।
নানান দেশের নানান ভাষাঃ বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণে উচ্চারিত হলেও বাবার প্রতি ভালোবাসার কোন পরিবর্তন হয়না। জার্মানিতে যিনি ‘ফ্যাট্যা’, এই বাংলায় তিনি ‘বাবা’। ছোট্ট এক ইংরেজ সন্তান যতটা আপ্লুত হয়ে ‘ফাদার বা ড্যাড’ ডাকে, ভারতীয়দের ‘পিতাজি’ নিশ্চয় ঐ একই ব্যঞ্জনা তৈরি করে। জার্মান ভাষায় বাবা শব্দটি হচ্ছে “ফ্যাট্যা” আর ড্যানিশ ভাষায় “ফার”। আফ্রিকান ভাষায় ‘ভাদের’ হচ্ছেন বাবা! চীনা ভাষায় চীনারা বাবাকে ‘বা’ ডাকেন! ক্রী (কানাডিয়ান) ভাষায় বাবা হচ্ছেন ‘পাপা’, তেমনি ক্রোয়েশিয়ান এ ‘ওটেক’! ব্রাজিলিয়ান ও পর্তুগিজ ভাষায় বাবা ডাক হচ্ছে ‘পাই’। ডাচ ভাষায় পাপা, ভাডের আর পাপাই এই তিনটিই হচ্ছে বাবা ডাক। সবচাইতে বেশী প্রতিশব্দ বোধহয় ইংরেজি ভাষাতেই। ফিলিপিনো ভাষাও কম যায় না, এই ভাষায় বাবা হচ্ছেন তাতেই, ইতেই, তেয় আর আমা। আবার ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় অর্থাৎ সেই ‘বাহাসা ইন্দোনেশিয়া’য় যদি বাবা ডাকি তাহলে সেটা হবে- বাপা কিংবা আইয়্যাহ! জাপানিরা তাদের ভাষায় বাবাকে ডাকেন- ওতোসান, পাপা। পূর্ব আফ্রিকায় অবশ্য বাবাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকা হয়! হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় পাপা ছাড়াও বাবা শব্দের অনেকগুলো প্রতিশব্দ আছে, যেমন- আপা, আপু, এদেসাপা। এমন আরো অসংখ্য ভাষাই রয়েছে পৃথিবীতে যার শব্দগুলো আরো অনেক মজার!
“ফাদারস ডে” বা “বাবা দিবস” উদযাপনের ক্ষেত্রে দেশ ভেদে দেখা যায় বৈচিত্র্য। এ দিবসটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। এদিনে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে কোনো না কোনো উপহার দিতে পছন্দ করে। আর বাবারাও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ভালোবাসা মাখা এসব উপহার পেয়ে বেশ অভিভূত হয়ে যান। এ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও দেশ ভেদে দেখা যায় ভিন্নতা। কোনো কোনো দেশে ছেলেমেয়েরা বাবাকে কার্ড বা ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানায়। আবার কোথাও কোথাও বাবাকে ছেলেমেয়েরা নেকটাই ও উপহার দেয়। অনেকে আবার বাবা দিবস উপলক্ষে কেক কাটার আয়োজনও করে। গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশেও বাবা দিবস বেশ ঘটা করে পালিত হচ্ছে। উপহারের দোকানে ভিড় হচ্ছে, টেলিভিশন এবং বেতারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে, সংবাদপত্রে বিশেষ লেখা ছাপা হচ্ছে। বাবার স্মৃতি এবং বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন অনুভূতির কথা লিখছেন পাঠকরাও; বাবা দিবসে পাঠকের সে লেখাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা বের করছে।
বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। বাবা, সে তো বাবাই। সেই “বাবা” শব্দটির সঙ্গেই অপার স্নেহ আর মমতার মিশেলে এক দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকি আমরা। একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিকবার উচ্চারণ করতে হয় যে শব্দগুলো তার মধ্যে `বাবা` অন্যতম।
বাবার প্রতি সন্তানের সেই চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও পৃথিবীর মানুষ বছরের একটা দিনকে বাবার জন্য রেখে দিতে চায়। যদিও বাবাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো বিশেষ সময়ের প্রয়োজন পড়েনা, তবুও বছরের অন্তত এই একটি দিনে সন্তানেরা তার বাবাকে মন খুলে তাদের ভালোবাসার কথা জানাতে চায়। “বাবা দিবসে” বিশ্বের সকল বাবাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
Comments
comments
Fatema Aktar Rumi